
বাংলা গান শুনেন এমন শ্রোতাদের কাছে অঞ্জন দত্ত শুধু একটি পরিচিত নাম না, অত্যন্ত প্রিয় একটি নামও বটে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। অঞ্জন দত্ত সেরকম একজন শিল্পী যার গান শুনলে, গানের প্রতিটা লাইনে, প্রতিটা অন্তরার গ্যাপে নিজেকে আবিষ্কার করি। অবাক লাগে একজন মানুষ কিভাবে কথা আর শুরের ছন্দে জীবনের ছবি আঁকে? অঞ্জন দত্তের অনেকগুলো গানে তিনি মধ্যবিত্তের পাওয়া, না পাওয়া, ব্যর্থতা, স্বপ্নভঙ্গ ইত্যাদি তুলে এনেছেন। তোমার জঙলাপাড়ের ঢাকেশ্বরী শাড়ি (মালা) গানটা কত-কতবার শুনেছি? ঠিক নেই। অনেক সময় গানটা চালাই শুধু অনেকদিন পরে অঞ্জনের গলা শোনার জন্যই। এখনো মাঝে মাঝে হাইকোর্ট মাজারের রাস্তা দিয়ে ফেরার সময়, কদম ফোয়ারার জলের ছিটে মুখে-চোখে মাখার সময় গুনগুন করে গেয়ে উঠি- ২৪৪১১৩৯…হ্যালো তুমি শুনতে পাচ্ছো কি?
অনেক গান অনেক সময় মস্তিষ্ককেও আক্রান্ত করে রেখে যায়। যেমন: এই বুড়ো পুরোনো গিটার দিয়েছে তোমাকে দিয়েছে- গানটা আমাকে খুব ভালোভাবে নিজের কব্জায় নিয়ে নিতে পারে। আরো দু’টো ছেলেমেয়ের বয়স বেড়ে যাবে- শুনলে অনেক নস্টালজিক হই। ববি রায়ের সাথে চলে যেও না শুনলে নিজের সাথে নিজের কথোপকথনের অনেক ছেলেমানুষি স্মৃতি ভীষণভাবে মনে পড়ে যায়। আর আজকে কি মনে করে জানি এই গানটাই বারবার শুনছি।
তবে মধ্যবিত্তিয় অনুভূতির সবচেয়ে বড় চিত্র সম্ভবত অঞ্জন দত্ত এঁকেছেন তার নাট্য গিতিকা ‘গানে গানে ভালোবাসা’ তে। জয়িতাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি মধ্যবিত্তের অসংখ্য না পওয়ার আর অপ্রাপ্তির মধ্যেও অহংকার করার মত কিছু অনুভূতির কথা বলেন। মধ্যবিত্তিয় অভিশাপের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে বেঁচে থাকার এই দিনগুলোতে অঞ্জন দত্তের এই কথাগুলোই সান্তনা। জয়িতাকে লেখা অর্নব চ্যাটার্জির সেই চিঠিটি হুবহু তুলে দিলাম।
=============
প্রিয় জয়িতা,
গতকাল সকালে তোমার চিঠি পেয়েছি। দু’দিন অফিসে যাইনি সারাদিন ধরে ভেবেছি। একবার ভেবেছিলাম তোমার চিঠির উত্তর দেব না। কিন্তু তারপর মনে হলো একদিন সময় মতো প্রপোজ করতে পারিনি আজ অন্তত ঠিক সময়ে সত্য কথাটা বলে ফেলাটা উচিৎ। না জয়িতা… আমি কোলকাতা ছেড়ে গিয়ে দিল্লীতে থাকতে পারব না। এবং সেই কারণেই তোমার কাকুর দেয়া হিন্দুস্থান টমসনের চাকরীটা আমি নিতে পারলাম না। জানি তুমি রাগ করবে। রাগের মাথায হয়ত একটু বেশী গাঁজা, সিগারেট, মদ খেয়ে ফেলবে। কিন্তু এও জানি সে নেশা কেটে যাবে তখন বুঝতে পারবে কেন আজ আমি পিছিয়ে পড়ছি। আসলে আমি বেসিকেলি ছা-পোষা ভিষনভাবে মধ্যবিত্ত, জানো! তাই আমার এই ছা-পোষা মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টটা আমি ছাড়তে পারলাম না। আমার যা কিছু পাওয়া সবই তো এই ছা-পোষা পরিবেশ থেকে পাওয়া। আমার মানিকতলার নোনা ধরা বাড়ির দেয়াল, স্যাঁতস্যাঁতে কলতলা, আমার মায়ের ছেঁড়া শাড়ির আঁচলের হলুদের গন্ধ এসব আমি ছাড়তে পারব না।
আমার রাস্তা, আমার বাড়ি, আমার ফাটা দেয়াল, আমার পোড়া মনের অজস্র জঞ্জাল
ভাঙছে কেবল ভাঙছে শুধু যাচ্ছে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আমার রাত্রি আমারই সকাল
একই ভাবে ঘামতে ঘামতে মনের ভেতর নামতে নামতে কোনমতে করছি দিনটা পার
চলছে চলবে… চলছে চলবে… এই ভঙাচুরা গল্পটা আমার
নাকে আমার পোড়া পিচের গন্ধ বুকে ধোঁয়া হাত পায়ে শুধুই অবক্ষয়
তবু কাশতে কাশতে এখনো যে হাসতে পারি ভালবাসতে নিজের কাছে নিজেরই বিষ্ময়
করব যে আর কত ঘিন্না নিজেই নিজের ছায়াটাকে করব যে আর কত অপমান
আবার তো সেই আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে নিজের নাকটাকে গাইব আমি ভালবাসার গান
এসো আমার ঘরে একবার, তুমি এসো আমার ঘরে একবার
পারো যদি দেখে যেও বেঁচে থাকা কারে বলে
এসো আমার শহরে একবার………………..
আমি এও জানি যে, আমার এই ভিষন ভাবে চেনা জানা আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা পরিবেশের সঙ্গে তুমি পাল্লা দিয়ে চলতে পারবে না। আমাদের ধর্মটা আলাদা বলে নয়। বিশ্বাস কর… না! আমাদের বড় হয়ে ওঠার মাঝে একটা বিশাল বড় ফাঁক আছে। তোমার স্বাধীন থাকার জেহাদ, তোমার উন্মাদনা, উচ্ছলতা, তোমার এক কথায় সবকিছুকে নস্যাৎ করে দেবার ক্ষমতাকে আমি শ্রদ্ধা করি, জয়িতা। আর করি বলেই তোমার মত একটা ভিষন ভাবে জ্যান্ত মানুষকে আমার এই ছা-পোষা মধ্যবিত্ত গন্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলতে চাই না।
তোমায় এতদিন বলা হয়নি, বলার প্রয়োজন পড়েনি আজ বলছি- আমার একটা দাদা ছিল, জানো! পিসতুতো দাদা। ৭১’সালে পুলিশ এসে তাকে তালতলার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওর কলেজের বন্ধুরা ওকে নাকি কিছু রাজনৈতিক লিফলেট ওর বাড়িতে রাখতে দিয়েছিল। আমার নিরীহ, নিপাট, ভালমানুষ দাদাটা কিচ্ছু না জেনে সেই লিফলেটগুলো বাড়িতে লুকিয়ে রাখে। থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশ ওকে প্রচন্ড মারে। সপ্তাহখানেক আটকে রেখে তারপর ভুল বুঝলে ছেড়ে দেয়। বাড়ি ফিরে আমার দাদা সোজা হয়ে হাঁটতে পারেনি। একমাস কোনমতে কুঁজো হয়ে বেঁচে ছিল তারপর কিডনী ফেইলর হয়ে মারা যায়। যাই হোক… মানে মোদ্দা কথাটা হলো, যেটার জন্য এতসব বলছি সেটা হচ্ছে যে, আমার ঐ নিপাট, নিরীহ, ভালমানুষ দাদাটা সেদিন তালতলা থানায় তাঁর বন্ধুদের নামগুলো কিন্তু বলে দেয়নি। আমার সেই দাদাটার কথা আজ খুব মনে হচ্ছে, জানো! আমার ভাবতে ভাল লাগছে সে মানুষটা আমার দাদা। এবং তার সঙ্গে এটাও ভাবতে ভাল লাগছে যে, আমার মতন একটা কেবলা একটা ছা-পোষা ছেলে দিল্লীর অতবড় চাকুরী, ভবিষ্যৎ, সাউথ ইষ্টের সঙ্গে ফ্ল্যাট সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার সাহস এখনো রাখে। এবং তার জন্য আমি গর্বিত, জয়িতা। তুমি আমার বন্ধু, তাই একদিন তুমি বুঝতে পারবে।
=============
মধ্যবিত্তরা বেঁচে থাক মধ্যবিত্ত হয়েই, হাজার বছর ধরে। মধ্যবিত্তিয় এই সব অনুভূতি প্রেরণা যোগাক অঞ্জন দত্তের মত হাজারো লেখককে।




“আরো দুটো ছেলেমেয়ের বয়স বেড়ে যাবে
আরো দুটো দিনের অবসান
আমার ছেলেমানুষিটা আঁকড়ে ধরে রেখে
গাইব আমি ভালবাসার গান ” এই গান টা আজ সকাল থেকে খুব মনে পড়ছিলো , গানটা আমার খুব প্রিয় তাই মনে রয়ে গেছে।আসলে ওর গানের মধ্যে আমি নিজেকে খঁজে পাই, কে যেন আমার কথা গুলো ছন্দে , তালে সাজিয়ে বলছে।তাই এখনো ওই গন গুলো গাই, ওই গান গুলো গাইবো বলে গিটার কিনেছি , ভুল কর্ড বাজাই আর গান গুলো নিজেই এনজয় করি।
Posted by Mohammad Rafiquzzaman | February 2, 2017, 12:20 pmখুব ভালো লিখেছেন , পড়তে পড়তে মনে হলো এগুলো তো আমিও ভেবেছি ! কিন্তু এত সুন্দর ভাবে গুছিয়ে বলে উঠতে পারি নি
Posted by Saiful Islam Galib | February 17, 2017, 1:21 pmতবে অঞ্জন দত্তের গান জীবনমুখী গানের ধারার মধ্যেও স্বতন্ত্র একটি সত্ত্বায় অবস্থান করে। তার গায়কীতে লোকসঙ্গীত, দেশীয় গান, ব্লু’স (উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আফ্রিকান-আমেরিকানদের সঙ্গীতের একপ্রকার ধাঁচ), ব্লু গ্রাস (আমেরিকার লোকসঙ্গীতের একটি গড়ন) এর প্রভাব লক্ষণীয়।
Posted by Ferdous Hasan | May 24, 2017, 6:23 pmসারাজীবনে শোনা অন্যতম চিঠিপঠন এটি। যারা শুনেছে তারা আবার শুনতে চান। আর যারা আজ প্রথম শুনে, তারা হয়ত বিস্মিত হন। এতোদিন কেনো শোনেননি, তাইই ভাবেন!
Posted by Raju Chowdhury | June 6, 2017, 7:27 pmএইটা যে কতোবার শুনেছি তার কোন হিসেব নেই। আরেকটা মজার বিষয়, অঞ্জন দত্তের গান আমার সব পরিস্থিতিতে ভালো লাগে। মন খারাপের সময় একরকম অনুভূতি আর মন ভালোর সময় অন্যরকম।
Posted by Sinthia Rahman | August 25, 2017, 8:46 pmএকদম মনের কথা বলেছেন। একেক পরিস্থিতিতে তার গানের আবেদন একেক রকম।
Posted by Md. Moulude Hossain | August 26, 2017, 2:51 pmতখন অডিও ক্যাসেট ছিল । এই ক্যাসেট শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় তেমন বুঝতাম না সব কথা কিন্তু খুব ভালো লাগত। এখনও সেই ভালো লাগা কাজ করে।
Posted by Nabil Sufian | July 12, 2017, 9:25 pmসেই ক্যাসেট থেকে ব্লু টুথ আবার ইউ টিউব, যখনই শুনি তখনই মনে হয় এই প্রথম বার শুনলাম। আর বন্ধু বা বান্ধবী কে উপহার বাবদ এর চেয়ে ভালো উপহার হয় বলে আমার মনে হয় না। তবে শেষে এসে আজও মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবিয়ে তোলে আজ জয়ী কি করছে? সেই রকমই ভাবিয়ে তোলে সে কেমন আছে??
Posted by Mehedi Hasan Rahat | September 11, 2017, 7:56 pmযখন পোস্ট graduate করি, তখন রোজ শুনতাম। তার পর দীর্ঘ বছর কেটে গেছে। তখনও চোখ জল আসতো..।আজ ও। তবে আজ মন অনেক পরিণত। জীবনে এই রকম এক বন্ধুর দরকার, যে নিজেকে চেনার জন্য সাহায্য করবে। ভীষণ ভালো লাগলো। অঞ্জন দত্ত ও নিমা রহমানক ধন্যবাদ অসামান্য শ্রুতিনাটক উপহার দেবার জন্য। ভালো জিনিসের কদর সবসময় আছে। কালের স্রোতে তা বিলীন হয়ে যায় না।
Posted by Yusuf Z Mannan | October 18, 2017, 9:57 pmকোথায় যেন চিঠির উষ্ঞ অনুভূতিটা আবার উকিঁ দিচ্ছে। বন্ধুত্ব, অপেক্খা, আর চিঠি কি অসম্ভব নেশা। অসাধারন এই শ্রুতিনাটক তার নমুনা।
Posted by Shahinur Ferdous Tuhin | October 20, 2017, 6:59 pmআমাদের জীবনে তার দুই সৃষ্টি ববি রায় আর রমা বারে বারে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাদের জীবনের গল্প, সাপোর্টিভ চরিত্র, অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস,সোস্যাল ইস্যুগুলো মুহূর্তের মধ্যে আমাদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ববি রয় বা রমা এর শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে তা নিয়ে জল্পনা চলে। মনে হয় ৫ মিনিটের গান নয়, ৩ ঘণ্টার সিনেমা দেখছি। অঞ্জনের গানগুলো তাই শোনার চাইতে মনের চোখে দেখার বস্তু হয়ে উঠে।
Posted by Khandakar Mohidul Tarek | October 27, 2017, 8:30 pmঅঞ্জন দত্তের গানের কথাগুলোতে অদ্ভুত এক টান আছে। গান শুনলে মনে হয় যেনো আমারই গল্প বলছে গানে গানে। ভালোলাগার অনুভূতিটাই অন্যরকম।
Posted by Minaoar Khansokar | December 20, 2017, 5:43 pmঠিক। তার গান শুনতে বসলে কেনো যেনো আপনা আপনি নিজের সাথে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার খন্ডচিত্র চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
Posted by Md. Moulude Hossain | December 29, 2017, 12:53 pmআগের মতোই প্রিয় রয়ে গেছে… আরও বেশি ভালোলাগলো। হয়তো একটু বেশি পরিণত হয়েছি বলে।
Posted by Fuyad Rahman | January 13, 2018, 4:52 pmএক কথায় অসাধারণ … প্রথম দিকটার খানিকটা প্রেম … নিজেকে ভাবিয়ে তুলছে … ইচ্ছা করছে কারও জন্য এমনি চিঠি লিখি … শেষ দিকটায় খানিকটা অপূর্ণতা!
Posted by Md Mohiuddin Mahin | April 25, 2018, 5:45 pmএই রকম সুন্দর শ্রুতিনাট্য বাংলা সাহিত্যে থাকতে পারে! যাস্ট শ্রবণ মুগ্ধকর, অনবদ্য,যারা শুনেনি তারা অবশ্যই মিস করলো।
Posted by Laboni Sultana Moni | June 27, 2018, 9:11 pmচারিদিকে এতো … প্রেম …. সবাই নাকি ভালোবাসতে শিখে গেছে… তবু এতো ভিরের মাঝে.. এই শব্দ গুলো, গল্প গুলো বাচতে শেখায়…..
Posted by Osman Haider Rony | August 25, 2018, 11:08 pm১৬ বছর আগে ক্যাসেট প্লেয়ারে বড় ভাইয়া সারাদিন শুনত। আমারও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঐ ৬ বছর বয়সে ভালো করে সব বুঝতাম না।কত খুঁজেছি এটা!! সেদিন নতুন করে পুরো আবৃত্তির মানে আবিষ্কার করলাম, অসাধারণ !! একেকটা গান এবং তার লিরিক স্পর্শ করার মত।
Posted by Nuria Jannat | December 18, 2018, 1:07 pm