
বাবা এই লিখাটা যখন তুমি পড়ছো ততদিনে আশা করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তুমি জেনে গেছো, তাই এই লিখাটা তাকে দিয়েই শুরু করছি। ঠাকুর বাড়ির উত্তর মহলের একটা ছোট ঘরে রবীন্দ্রনাথ বসে ছিলেন। দিলীপ রায় সঙ্গীসহ কবির ঘরে ঢুকলে কবি উচ্ছসিত হয়ে তাকে অভ্যর্থনা করলেন, এসো এসো। দিলীপ রায়ের বইয়েরই কথা হচ্ছিলো সম্ভবত। রবীন্দ্রনাথ বললেন, লেখাগুলো ভালো লেগেছে, জ্ঞানের ব্যাপারে আমার অজ্ঞতা যে কতদূর তা জানতাম না। আমি গান রচনা করেছি, সুর দিয়েছি, গেয়েছি কিন্তু কোনদিন ওর পান্ডিত্যের দিকটায় পা বাড়াইনি। দিলীপ রায় জবাবে বললেন পান্ডিত্য জিনিসটা কি খারাপ? কবিগুরু বললেন লেখকের যেটা বলবার কথা পান্ডিত্য যখন সেটাকে ছাড়িয়ে যায় তখন সাহিত্যের হয় ভরাডুবি। সাহিত্যে জাহিরিপনার স্থান নেই। দিলীপ রায় লজ্জা পেয়ে বললেন, সবই বুঝি কিন্তু লোভ সামলানো সহজ কথা নয়, পান্ডিত্যের লোভ!
শুরুটা এই গল্প দিয়ে কেন শুরু করলাম জানো? তোমার জন্মদিনের আগের রাতে তোমার মা আমাকে বলছিলো এবার বাবুর জন্মদিনে কিছু লিখলে না? এই সহজ প্রশ্নটার মধ্যে একধরণের অসম্পূর্ণতা ছিলো। কেমন জেনো খেয়ে হারানো ব্যাপার ছিল তার অভিব্যক্তিতে, কিন্তু কোন উত্তর তাকে দেইনি, কারণ ওইযে পান্ডিত্য ব্যাপারটা আমার সাথে কেমন জেনো বেমানান। আর তোমাকে নিয়ে লেখায় পান্ডিত্য – সেটাতো আরো কঠিন! ভাবছিলাম কি নিয়ে লিখবো? কি বলবো তোমাকে? তোমার আগের দুই জন্মদিনের লেখায় তোমার জন্য আমার কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের নির্দেশনা ছিল। এবার তাহলে কি? বেশি ভাবিনি, ওইযে পান্ডিত্যকে প্রতিপাদ্য করতে আমার অনীহা। অবশেষে নিজের বর্তমান আর অতীতের গল্পে জড়িয়ে নিলাম তোমাকে!
ইতিমধ্যে তুমি তিন বছর পুর্ন করেছো এবং এটা এমন সময়ে যে সময়কে পৃথিবীর সবাই মনে রাখবে অন্তত আরো একশ বছর। বিচ্ছিন্নতা, বিষন্নতা আর মহামারীর এক বছর মানুষকে পিছিয়ে দিয়েছে আরো একশো বছর। এই মহামারীর সময়ে, গত এক বছরে তোমার অর্জনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ তোমার কথা বলতে পারা। কথা বলাটা আগেই রপ্ত করেছিলে তুমি, কিন্তু এখন সেটা আরো গোছানো আরো প্রাণবন্ত। এখন স্বপ্ন হচ্ছে তোমার কথা বলার ক্ষমতাকে আরো বিকশিত করতে শেখানো। যুক্তি দিয়ে নিজের চিন্তাকে কথার ব্যাকরণে প্রতিষ্ঠিত করতে পারাটা কত জরুরি সেটা প্রতি পদক্ষেপে অনুভব করি আমি. আমার এই না পারার অপ্রাপ্তি থেকে তোমার মুক্তির প্রার্থনা করি প্রতিনিয়ত। কথার পিছনের কথাকে কালি ও কলমের সন্ধিতে বাঁধার অভ্যাসটাকে যদি উচ্চারিত শব্দের মারপ্যাঁচে জড়াতে পারতাম তাহলে তোমার বাবার গল্পটা আজ অন্যরকম হতে পারত।

আমি চাই তুমি আরো কথা বলো, তোমার প্রতিটি চাওয়া আর কথার বিপরীতে যুক্তির অভিসন্ধি তোমার বড় হয়ে উঠাকে আরো পরিপুর্ন করবে। তোমাকে প্রস্তুত করবে পৃথিবীর চাতুর্য থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে। লিখতে পারার মধ্যে একধরনের আত্নতুষ্টি কাজ করে কিন্তু সেটা জীবনের কথা বলতে পারার প্রয়োজনীয়তাকে তুষ্ট করতে পারেনা। সাদা কাগজে লিখা কথাগুলো পরাধীনতার ব্যাথা নিয়ে আমার মতোই ছটফট করে, কিছু কিছু অজানা থেকে যায় আর কিছু থেকে যায় অবহেলিত! এই অজানা আর অবহেলার অনুরাগ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কথা দিয়ে চাতুর্যের দেয়াল ভাঙার কোন বিকল্প নেই। তর্ক-বিতর্কের এই খেলায় সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার যুক্তিসঙ্গত পথ আর পাথেয় তোমাকে সমৃদ্ধ করবে আগামীর পথযাত্রায়।
তবে সেই কথা বলতে পারা এবং কথা দিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস জেনো কোনভাবেই তোমার অহংকারের স্বাক্ষর না হয়ে যায়। আমি আগের একটি লিখায় তোমাকে বলেছিলাম জীবন কোন যুদ্ধ নয় যেটাতে তোমার জয়ী হতে হবে, জীবন একটি ভ্রমণ যতটুকু পারো সেই ভ্রমণটাকে অর্থবহ করার চেষ্টা করো. বুকের ভেতর দ্বিধা নিয়ে সময়কে নিয়তির ফলাফল বানানো যেমন ঠিক না তেমনি, নিজের আমিত্ববোধকে প্ৰতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অন্যের অনুভূতিতে আঘাতও গ্রহণজোগ্য নয়। সময়টা আসলে আপেক্ষিক, জীবন নদীতে জোয়ার আসে; আবার ভাটা আসে, কিন্তু বাস্তবতার বাঁকে বাঁকে জীবনের সুধা নি:শেষিত হবে না দুই হাত প্রসারিত করে দরজার বাহিরে প্রতীক্ষারত সুদীর্ঘ সুসময়ের সাথে আলিঙ্গন হবে সেটা আমাদের নিজের পছন্দ হওয়া উচিত। প্রত্যাশা থাকবে তোমার কথা বলতে পারার মধ্যে তিনটা জিনিস যেন প্রধান পাতিপাদ্য হয় – অন্যের প্রতি সম্মান রেখে বা শ্রদ্ধাপূর্ণ কথা বলা, বিনয় ও মমতাপূর্ণ কথা বলা এবং কৃতজ্ঞতাপূর্ণ কথা বলা।
শুরুটা করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের গল্প দিয়ে, শেষটাও রবীন্দ্রনাথের গল্পে করতে চাই। রবীন্দ্রনাথ একদিন তার ঘরে বসে গান লিখছিলেন,সেই সময় তার ঘরে এক মেয়ে প্রবেশ করে। মেয়েটি কিছুক্ষন আগে রবীন্দ্রনাথকে দেয়া পিঠার হাড়ি নিতে এসেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে পিঠা কেমন হয়েছিলো জানতে চাইলে, কবি ঠাকুর মজা করে তাকে বলেছিলেন “কাঠ কঠিন লোহা কঠিন আরো কঠিন ইষ্টক, তাহার চেয়ে কঠিন কন্যা তোমার হাতের পিষ্টক।” রবীন্দ্রনাথের মতো করে আমিও বলতে চাই – কবিতা কঠিন, গল্প কঠিন আরো কঠিন উপন্যাস, তাহার চেয়েও কঠিন বাবা তোমার তরে শব্দ বিন্যাস! পান্ডিত্যের লোভটা সংবরণ করে তোমার জন্য কিছু একটা লেখার প্রচেষ্টা ছিল মাত্র। পরিশেষে বর্তমান সময়ের আমার অন্যতম প্রিয় কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের কয়েকটি পংক্তি তোমাকে উৎসর্গ করে লিখাটির সমাপ্তি করতে চাই –
“অন্ধকারের বেলাভূমি বালিয়াড়ি
পার হয়ে যাবে কনভয় আগে ভাগে
জ্যোৎস্নায় ভিজে ফিরবো সবাই বাড়ি
পতাকা উড়াবো সূর্যদয়ের আগে।”
পৃথিবীর চাতুর্যকে পিছনে ফেলে শব্দ ডানায় তোমার উড়াল দেয়ার প্রত্যাশায় – তোমার বাবা।
Also Read:
বিচ্ছিন্ন শব্দের কথামালা অথবা নির্ভেদের জন্য ভালবাসার অর্ঘ্য আমার পূর্নতার এক বছর – ভালোবাসার অন্য নাম নির্ভেদ
অসাধারণ লেখনি। শুভ কামনা!
ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
শুভ কামনা বাবা! ভালোবাসা অবিরত।
Wish You Both Sound Life
ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।