নব্বই দশকের প্রজন্ম নিয়ে অনেক কথা অনেক গল্প এখনও চায়ের আড্ডায় প্রজন্ম প্রতিনিধিদের নস্টালজিক করে তোলে। তবে নব্বই দশকের প্রজন্মকে সংজ্ঞায়িত করার সুনির্দিষ্ট কোন রেখা মনে হয় কোন আলোচনায় নেই। নব্বই দশকের প্রজন্ম বলতে আমরা কাকে বুঝি? নব্বইয়ের দশকের জন্ম নেয়া না আশির দশকে জন্ম এবং নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা? তবে মোটামুটিভাবে বলা যায় বর্তমান সময়ে যাদের বয়স ৩০শের কোটায় তারা কোন না কোন ভাবে নব্বইয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এটা আসলে কোন প্রজন্ম যুদ্ধ নয়। এটা শব্দ আর বাক্যের আদলে নিজের ফেলে আসা দিনের ছবি আঁকা! ৯০ দশকের প্রজন্ম হিসেবে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করার মূল প্রেক্ষাপট তুলে ধরার প্রয়াসে এই লেখা। সে প্রেক্ষাপটকে কয়েকটি ভিন্ন অবয়বে আলোচনা করছি এই লেখায়।
১। ৯০ দশকের শৈশব এবং কৈশোর
বর্তমান আধুনিক প্রজন্মের সাথে আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে আমাদের বেড়ে উঠার মাঝে। যদিও গবেষণা প্রলুব্ধ নয়, তবুও ৯০ দশকের প্রজন্মই সম্ভবত প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠা সর্বশেষ প্রজন্ম। জীবনের সর্বস্তরে প্রযুক্তির প্রসারের সবচেয়ে বড় সাক্ষী এই প্রজন্ম। মাঠির কাছাকাছি এবং মাঠি আর পানির স্পর্ষে কাটানো দুরন্ত সেই সময়গুলো কোন ফ্রেমে আবদ্ধ করা হয়নি ঠিকই কিন্তু মনের ফ্রেমে সেই সময়গুলো এখনও অম্লান। গ্রাম্য মেলায় কেনা মিষ্টি খই, তাল পাখা, বাঁশি কিংবা একটাকা দামের চকলেটের সাথে শৈশবের সেই আবেগ! অগ্রাহায়ন মাসে ধান কাটা হয়ে গেলে, ন্যাড়া কেটে শীত কাটাতে আগুন পোহানো, স্কুল পালিয়ে মোস্তফা খেলা কিংবা তাল পড়ার শব্দে দীঘির পানিতে ঝাঁপ। স্কুলের পড়ার বইয়ের মাঝে রেখে লিটল ম্যাগাজিন, তিন গোয়েন্দা বা মাসুদ রানা পড়া! আজকের হাতের মুঠোয় সবকিছু থাকা স্বত্বেও কেনো যেনো মনে হয় কিছু একটা নেই। এই সব থাকার মাঝে না থাকার এই অনুভূতি বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলা আসা সময়ের সৃতির বালুচরে।
২। ৯০ দশকের বিনোদন
এই দশকের প্রজন্মের কাছে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিলো নিজেদের মধ্যে দল বেঁধে উম্মাদনা আর দুরন্তপনা। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারনে ক্রিকেট ফুটবল কমই খেলা হতো, তবে লাটিম, দাঁড়াকটি (ডাংগুলি), বন্দি (বাঘবন্দি), বৈঁচি, সাতচিক (সাতচাড়ারখেলা), কুতকুত, কিংবা দল বেঁধে ঘুড়ি উড়ানো। তবে এই প্রজন্মের জন্য বিনোদনের সবচেয়ে নস্টালজিক দিনের নাম শুক্রবার! নামাজে যাওয়ার আগে বিটিভি’র প্রথম অধিবেশন বন্ধের সময় বিকেলের অনুষ্ঠানসূচীতে সিনেমার নাম এবং নায়ক-নায়িকার নাম শুনার চেষ্টা। পছন্দের নায়ক হলে পুরোটা সময়ের উত্তেজনা আর বিকেল তিনটার সেই অধির অপেক্ষা। এছাড়াও রাতের আলিফ-লায়লা, দ্যা নিউ এডভেঞ্চার অব সিন্দাবাদ, রবিনহুড, ম্যাকগাইবার, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান ইত্যাদি। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বাড়ির সবাইকে জানান দিয়ে স্কুলের পড়া! স্কুলের যাওয়ার জন্য বাবার দেয়া হিসেব করা গাড়ি ভাড়ার বেশী ১/২ টাকা কারো কাছ থেকে পওয়া মানে ছিলো বিশ্বজয়ের মতো ব্যাপার। আজকের হাজার হাজার টাকাও সেই টাকার অনুভূতির কাছে ম্লান। এই দশকের সিনেমার প্রতি মানুষের টান, বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের সোনালী সময় এর প্রজন্মের সময়ে। আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, মাকসুদ, পার্থ, মাইলস এরা সবাই এই প্রজন্মের কাছে এক একটা উপমা।
৩। ৯০ দশকের পড়াশোনা এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক
৯০ দশকের আমার মতে সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পর্ক ছিলো ছাত্র এবং শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্ক। এই দশকে একজন ছাত্রের জীবন দর্শনে একজন শিক্ষকের প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশী। সেই সম্পর্ক টাকার পরিমাণ দিয়ে বিচার হতোনা, বিচার হতো শ্রদ্ধাবোধ দিয়ে। প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক রাতের বেলায় ঘরে ঘরে গিয়ে তার ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া লেখার খোঁজ খবর নিতেন। স্কুলের সবচেয়ে ডানপিঠে ছেলেটি একজন স্যারের নাম শুনে থরথর করে কাপার উদাহরণ মনে হয় এখন পাওয়া যাবেনা। ছাত্রছাত্রীদের কাছে একসময়ের সবচেয়ে বড় আতংককে পরে দেখে বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নথ হয়ে যাওয়ার গল্প এখনকার প্রতিশোধ পরায়ণ প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই শুনাবে।
৪। আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের রাজসাক্ষী
সন্দেহাতীতভাবে ৯০ দশকের প্রজন্ম বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সাক্ষী। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হত্যা করে ক্ষমতা দখলের ইতি দেখেছে এই প্রজন্ম। তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তাব্যাক্তিদের হত্যার এই ধারা বন্ধের পাশাপাশি এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভাব হয়েছে গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র। এই গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের হাত ধরে সন্ত্রাস আর রাজনীতির আমোঘ সম্পর্ক পেয়েছে প্রাতিষ্টানিক স্বীকৃতি। ধীরে ধীরে শিল্পায়ন আর অবকাঠামো উন্নয়েনের সাজানো নাটকের সাথে শিক্ষাও যুক্ত হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণায়। স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু তার বেশীরভাগই একটি নির্দিষ্ট গোষ্টিকে পৃষ্টপোষকতার জন্য। এইসব নব্য প্রতিষ্টিত শিক্ষালয়গুলো স্বনির্ভর মানুষ তৈরি না করে গড়ে তুলছে কেরানি হওয়ার মানসিকতা। এইসব সুবিশাল পরিপ্রেক্ষিত প্রতক্ষ্য এবং পরোক্ষ্য ভাবে প্রভাব রেখেছে এই প্রজন্মের উপর। বর্তমানে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের এই ব্যাপক বিস্তারের পিছনে এই প্রজন্মের বেড়ে উঠার ক্ষেত্র অন্যতম প্রভাব রেখেছে।
৫। ৯০ দশক এবং বাংলাদেশের ক্রিকেট
বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রিকেট নিয়ে যে উম্মাদনা তার বীজ রূপায়িত হয়েছিলো সেই নব্বইয়ের দশকেই। বিটিভি’তে সচরাচর খেলা দেখাতো না, তখন বাংলাদেশের খেলার খবরের একমাত্র উপায় ছিলো রেডিও। রেডিওতে কান লাগিয়ে ক্রিকেটের সর্বশেষ খবর জানতে চাওয়ার চেষ্টা, আইসিসি ট্রপিতে বাংলাদেশের শেষ বলে জয়ের মাধ্যমে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের পদচারনার শুরু নব্বয়ের দশকে। ১৯৯৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেই দিনের কথা মনে হলে আজো শরীর গরম হয়।
এই দশকের স্বকীয়তা এবং এই প্রজন্মের বেড়ে উঠার প্রেক্ষাপট নিয়ে বলার অনেক কিছুই আছে। আমাদের পরের প্রজন্মেরও কিছু স্বকিয়তা আছে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিছু আমাদের প্রজন্মই সম্ভবত বাংলাদেশের সামগ্রিক পট পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সাক্ষী। এই দশকে বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রেই লেগেছে পরিবর্তনের ছোয়া, তাই এই প্রজন্মও হয়ে রেয়েছে সমসাময়িক দুই সময়ের সাক্ষী হয়ে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা – প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষ লড়াই করে যাচ্ছে কোন কোন প্রতিযোগিতা জয়ের নেশায়। এই বিশাল পরিপ্রেক্ষিত এই প্রজন্মকে করেছে অন্য প্রজন্ম থেকে আলাদা এবং স্বকীয়। এই উত্তরাধুনিক সমাজের মধ্যবয়সী এই আমি একান্তে-নির্জনে এখনও অনুভব করি সেই ফেলে আসা সময়ের অভাব, নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে।
কোথায়ও কেউ নাই, এই সব দিন রাত্রি, সকাল সন্ধ্যা, মুভি অব দ্যা উইক, এন্টেনাতে পাতিলের সরা লাগিয়ে DD7, DD1, পাপাই শো, ইস্কুবিডু। আরো অনেক কিছু ই ছিল মজার দিনগুলো।
৯০ দশক এর খেলা গুলো অনেক মিস করি.র্মাবেল,লাটিম,ডাঙ্গলি,বৌচি,গৌলাছোট আরও কতকি আহহ কি দিনগুলো ছিল তখন!!!
মুখে কিছু না বললেও এখনো অনেকে সেই পুরনো বিটিভিকে খুঁজে ফেরে! খুঁজে ফেরে ম্যাকগাইভার, আলী বাবাদের শুধু দেখার জন্য নয় বরং একটা ধন্যবাদ দেয়ার জন্যও। কেননা আমাদের অনেকের শৈশব আর কৈশোর যে ঋনী তাঁদের কাছে, ঋনী বিটিভির কাছে!
এক সময় টিভির কোন রিমোট ছিল না, ছিল না এত চ্যানেল! রিমোট থেকেও লাভ হতো না, কারন চ্যানেল ছিল একটি। মাঝে মধ্যে ভারতের দূরদর্শন হয়তো দেখা যেতো! পরিবারের সবাই এই একটি চ্যানেল দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতো। চ্যানেলটির নাম- ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’!
বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার কিংবা রুপনগর, ইতিকথা’র মত অসংখ্য কালজয়ী নাটক এক সময় এই চ্যানেলটিতে প্রচার হতো। আলিফ লায়লা, ম্যাকগাইভার, মিস্ট্রিয়াস আইল্যান্ড এর মত অনুষ্ঠান এক সময় দেখা যেতো এই চ্যানেলে!
মনে পড়ে গেল সেই হারানো দিনগুলি, সত্যি আমরাই বোধহয় সবচেয়ে ভাগ্যবান প্রজন্ম! পোস্টে ভালো লাগা!
ফেলে আসা ৯০ দশক এর সময়টা এমনই ছিল যেখানে মায়া মমতা ঘেরা সময় কাটাতো সকলে। আমরা তখনও জানতাম না, আমরা সকলে মিলে মিশে থাকার মধ্যে খুঁজে পেতাম আনন্দ। আমরা জানতাম না একাকীত্ব কি কেমন তার স্বাদ। সবাই মিলে গল্প গুজব আড্ডা সবকিছুই হতো একই ছাঁদের নিচে কিংবা ছায়ায়। মনে পরে মান্না দে’ এর কালজয়ী গান কফি হাউজ? একটা টেবিলে সেই ৩/৪ ঘন্টা চার মিনার ঠোঁটে জ্বলত! এটাই, তখন আমাদের ব্যস্ততারাও অবসরে ছিল। আমরা গল্প গানে সময় কাটাতে জানতাম। সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া কিংবা বসে গল্প করা ছিল হরহামেশার ঘটনা। টেলিভিশন বা সিনেমা হলে থাকতো লম্বা লাইন। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে পার হতো সময়। হুমায়ূন আহমেদের নাটক আর সিনেমার জন্য করা হতো অপেক্ষা। এমন সবকিছুই ছিল আমাদের সেই ফেলে আসা ছোটবেলায়।
৯০ দশক কেবল একটি সময়কাল নয়! এটা একটা অনুভূতি, একটা আবেগ! এই সময়ে যারাই জন্মেছে বা এই সময়টা পেয়েছে তারা যেমন চিঠি লিখেছে মনের কথা পাঠাতে তেমনি আবার ভিডিও কলেও কথা বলেছে। চিঠি পাঠিয়ে অপেক্ষায় থাকার স্বাদ যেমন তারা পেয়েছে তেমনি কয়েক সেকেন্ডে প্রিয়জনদের দেখার সুখটাও পেয়েছে। মিটে গেছে যোজন যোজন দূরত্ব। মাইলের পর মাইলের দূরত্ব ঘুচতে দেখেছি আমরা। তাই বলা যায় বিশ্বায়নের যুগে এমন অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে।
ছোট বেলার এমন একটা সময় যেখানে ৯০ দশকের ছোটদের সময় কেটেছে চমৎকারভাবে! কখনো ঘরে খেলে কখনোবা বাইরে খেলতে গিয়ে। কখনো ভাই বোন মিলে ক্যারাম খেলেছি কখনো বা লুকোচুরি। আবার কখনো সেই ৯০ দশকের প্লে স্টেশন এ খেলা হতো “ব্রিক গেম”। কি চমৎকার সময় ছিল।