কয়েক বছর আগে আর বর্তমানে আমার সিনেমা দেখার ধরনের মধ্যে বেশ বড় একটা ফারাক আছে। আগে সিনেমা দেখাটা ছিলো কোন ধরনের বিচার বিবেচনার উর্ধে, আর এখন সিনেমা দেখাটা অনেকটা Word of Mouth টাইপ ব্যাপার। তাছাড়া, এখনকার আমার সিনেমা পছন্দের ধরনটাও ভিন্ন। এখন একটু Unconventional টাইপ সিনেমার প্রতি ঝুঁকটা বেশী। আর তাছাড়া, আমার সিনেমাখোর বন্ধু জয়ের Recommendation বড় একটা প্রভাব রাখে সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে। Unconventional সিনেমার ক্ষেত্রে বলিউডে রাজকুমার রাও এবং আয়ুষ্মান খুরানার সিনেমাগুলো অন্যরকম একটা আবেদন নিয়ে আসে। সে হিসেবে ২০১৯ সালের দিওয়ালিতে মুক্তি পাওয়া রাজকুমার রাও অভিনীত “মেইড ইন চায়না” সব দিক থেকেই আমার জন্য একটা মাস্ট-ওয়াচ মুভি ছিলো। ভালো প্রিন্টের অপেক্ষায় ছিলাম অনেক দিন ভাগ্যক্রমে ভালো প্রিন্ট আর উইকেন্ড একসাথে কড়া নাড়লো আর আমি পেয়ে গেলাম মাথা হাঙ্কা করা একটা লেখার বিষয়বস্তু।
শুরুতেই বলে রাখি, এই লেখা কোন রিভিউ না। Unconventional একটা সিনেমা নিয়ে Unconventional একটা লিখা। এই সিনেমার মুল বিষয়বস্তু হচ্ছে সেক্স এবং ব্যাবসা উদ্যোগ, আর সিনেমার ঘটনা প্রবাহে উঠে আসে ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত কিছু দৃষ্টিভঙ্গি, যা এই সিনেমার ধরনের মতই Unconventional ভাবে ব্যাখ্যা করে। এই রকম কয়েকটা পয়েন্ট নিয়েই আলোচনা তুলে আনার চেষ্টা আছে এই লিখায়। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে সিনেমার কয়েকটি চরিত্র তুলে ধরতে চাই। সিনেমাটির গল্প রঘু নামে একজন ব্যার্থ উদ্যোক্তাকে নিয়ে, যার ইতিমধ্যে ১২/১৩ টি উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে (ভালো লাগছে, কারন এখন পর্যন্ত মাত্র ৭ টি ব্যার্থ উদ্যোগের উদ্যোক্তা!!)। তার সাথে আছে ৭০ বছর বয়সী অভিজ্ঞ একজন Sexologist (ডা হার্দিক ভার্ধি), একজন সফল ব্যবসায়ী ও এঞ্জেল ইনভেস্টর (তন্ময় সাহ), একজন মটিভেশনার স্পিকার/বিসনেস কোচ (অভয় চোপড়া) আর একজন তরুন সফল ব্যবসায়ী (দেবরাজ)। সাথে আরো কিছু চরিত্র আছে যাদের সাহায্যে মুখ্য চরিত্রগুলো বিকাশ এবং সিনেমার গল্প সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
এবার আসি মূল আলোচনায়। সিনেমায় একটি ব্যবসা উদ্যোগের অনেকগুলো বিষয় উঠে আসছে যার মধ্য তিনটা দৃষ্টিভঙ্গি আমার এই লেখায় একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
১। কাস্টোমার কি?
চায়নাতে দেবরাজের সাথে একটি ভিজিটে তন্ময় সাহের সাথে প্রথম পরিচয় হয় রঘুর। রঘুর সারল্য আর রঘুকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে ডাকার কারনের তন্ময় সাহ আর রঘুর মঘ্যে একটা আন্তরিক সম্পর্কের সূচনা দেখতে পাই আমরা। তারই প্রেক্ষিতে, রঘু এবং তন্ময় সাহ এর মধ্যে কাস্টোমার নিয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় তন্ময় সাহ রঘুকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে “কাস্টোমার হলো ইডিয়ট (চুতিয়া)” – কেন? তন্ময় সাহের ব্যাখ্যায় উঠে আসে কাস্টোমারের নিজের চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব। কাস্টোমার নিজেই জানে না সে কি চায়, সে শুধু তার প্রয়োজনটাকে প্রকাশ করে আর একজন সফল উদ্যোক্তার কাজ হচ্ছে সেই প্রয়োজনকে চাহিদার রুপ দিয়ে, কাস্টোমারকে বলা আসলে সে কি চায়! একটা সফল উদ্যোগের সূত্রপাত হচ্ছে, কাস্টোমারের প্রয়োজনকে চাহিদায় রূপান্তর করে একটি সমাধান নিয়ে তার কাছে যাওয়া। Sell the solution of a problem… don’t offer on a solution without any problem.
২। ব্রান্ড কি?
সেক্স সংক্রান্ত সমস্যায় জর্জরিত বিশাল এক গ্রাহক থাকার পরও, রঘুর উত্তেজনা বর্ধক ঔষুধ মার্কেট পাচ্ছে না। একটা সুপরিকল্পিত Direct Marketing Effort এবং Distribution Network তৈরি করার পরও যখন রঘুর “Magic Soup” বিক্রি হচ্ছেনা তখন রঘু আরো একবার তন্ময় সাহের দারস্ত হয়। তন্ময় সাহ রঘুর পন্যের আইডিয়া ভালো বলার পর রঘু জানতে চায় বিক্রি বাড়ার জন্য কি করা উচিত। তন্ময় সাহ উত্তরে বলে, তুই ভূল জিনিস বিক্রি করছিস! “Magic Soup” তোর পন্য, তুই এটাকে কেনো বিক্রি করছিস? তুই ব্রান্ড বিক্রি কর? রঘু বুঝে উঠতে না পেরে ব্যাখ্যা চাইলে তন্ময় সাহ বলে তো কাছে ৭০ বছর বয়স্ক একজন অভিজ্ঞ Sexologist আছে তুই তাকে বিক্রি কর, এই ভার্দি তোর ব্রান্ড আর Magic Soup তোর পণ্য। পণ্য বিক্রি না করে ব্র্যান্ড বিক্রি কর। ব্র্যান্ড এবং পণ্যের এই সমীকরণ বুঝাতে তন্ময় সাহ বলে, “কাস্টোমারের মাথা হচ্ছে আঁখের খেত, যার এক একটি আঁখের গাছ এক একটি পণ্য। আর ব্র্যান্ড হচ্ছে সেই পাগলা ষাঁড়, যে প্রচণ্ড শক্তিতে আঁখের খেতে প্রবেশ করে আঁখ গাছ তচনচ করে নিজের জায়গা করে নেয়।” এর পর রঘু ডা হার্দিক ভার্দিকে জনপ্রিয় করার পরিকল্পনা করে এবং ভার্দির মাধ্যমে নিজের পণ্য মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দিতে সক্ষম হয়।
৩। সঙ্কট থেকে সম্ভাবনা
সিনেমার শুরুতে একজন চাইনিজ জেনারেলের ভারতে মৃত্যুর তদন্ত দেখানো হয়। সেই জেনারেলের মৃত্যুর পিছনে Magic Soup এর একটা সমীকরণ থাকায়, CBI এর তদন্ত কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হতে হয় রঘু এবং ডা ভার্দিকে। তদন্তের শেষ পর্যায়ে যখন রঘু নিজের পরাজয় আর পতন দেখতে পাচ্ছে, তখন তন্ময় সাহ রঘুকে ফোন করে বলে “এই মুশকিল (সঙ্কট) কে মওকা (সুযোগ) বানা আর মার দে ছক্কা!” এই ছক্কাটা কি ছিলো? এখন পর্যন্ত রঘুর এই ব্যবসার কোন স্বীকৃতি ছিলো না, পুরো ব্যবসা চলতো Underground Market এ, এই কেস আর তদন্তের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে রঘুর এই ব্যবসা সরকারী ও সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। তবে পুরো কেস এবং তদন্তে পিছনের খেলাটা দর্শকের কাছে Suspense হিসেবে থেকে গেছে। পুলিশ তদন্তে বলা হচ্ছে Magic Soup এ চাইনিজ বাঘের Reproductive Organ ব্যবহার করা হয়েছে যদিও রঘু বলে আসছে তার Magic Soup এ কোন পশুর কোন অঙ্গ ব্যবহার হয়নি। সাধারন খাদ্য উপাদান যেমন দুধ, বাদাম, এলাচ ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে এই Magic Soup Powder, মানুষ এটা খাওয়ার পর একটা মানসিক শক্তি থেকেই তার রোগ নিরাময় হচ্ছে। রঘুর মতে এটা পুরোটাই মানুষের চিন্তার খেলা।
এর বাইরেও ব্যবসার আরো কিছু দৃষ্টিভঙ্গি এই সিনেমায় উঠে এসেছে। যেমন, একটা ব্যবসা শুরু ক্ষেত্রে একজন সৎ ও যোগ্য পার্টনার কতটা জরুরি। ডা ভার্দিকে নিজের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে নির্বাচন করার আগে রঘু দুই মাসে ২৫ জন Sexologist, ১৯ জন বাবা, ১২ জন জ্যোতিষী এবং ৪ জন তান্ত্রিকের সাথে একজন রোগী হিসেবে কথা বলে। কিন্তু এদের কাউকেই তার পার্টানার হিসেবে যোগ্য এবং সৎ মনে হয়নি। ডা ভার্দি ছাড়াও তার টিমের প্রত্যেক মেম্বার নির্বাচনের পিছনে সুনির্দিষ্ট কারন ছিলো। সেই সাথে বিনিয়োগকারী এবং পণ্য বিতরণ ব্যবস্থা গড়তে কৌশলগত কিছু পদক্ষ্যেপ ছিলো। বিভিন্ন হসপিটাল থেকে যৌন রোগীদের তালিকা বের করে তাদেরকে কল এবং ইমেইলর মাধ্যমে Direct Marketing ইত্যাদি।
তবে এই ছবিতে ব্যবসা এবং উদ্যোক্তাদের নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কিছু বিষয়ও উঠে এসেছে। যেমন বান্ধবীদের কাছে গল্প শুনে নিজের স্বামীর জন্য Magic Powder কিনে আনা স্ত্রীও স্বামীকে এই ব্যবসায় মেনে নিতে পারে না। অন্য অনেকগুলো শারীরিক সমস্যার মত এই সমস্যা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায়না। নিজের ব্যক্তিজীবনে খুশি না থাকতে পারার হতাশার কারনে বাড়তে থাকে Domestic Violence, Rape, Child Abusement এবং Sexual Harassment এর মত অপরাধ। এই সব সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তারিত লেখা পরে কোন একদিন হবে, আজকের মত এখানেই বিদায়।
Stay fine, stay healthy and keep smiling… people looks beautiful when they smile
ব্যবসা উদ্যোগের একদম প্রাথমিক বেশ কিছু বিষয় নিয়েও কয়েকটা দৃশ্য ছিলো সিনেমায়। আর রাজকুমারের অভিনয়ও সেই লেগেছে।
ছবিটা দেখেছিলাম আগেই কিন্তু আপনার এই লেখাটা পড়ার পর আবারও দেখলাম। নতুন করে দেখার অভিজ্ঞাতাটা দারুন ছিলো। ধন্যবাদ।