you're reading...
বাংলা ছোট গল্প (Bangla Short Story)

বুড়ীর প্রলাপ এবং আবুলের দ্বিতীয় বিয়ে

তখন সবেমাত্র গোঁফের কালো রেখা নাকের নীচে দেখা দিতে শুরু করেছে। মার হাতের পিটুনি খাবার ভয় উপোশ করে সরাসরি সত্য কথা বলার সাহস তখনও সঞ্চয় করতে পারিনি। বাড়ির চৌসীমানার ভেতর নিজের দুরত্বপনা টিকিয়ে রাখতে মাঝে মাঝে বাড়ির কলাগাছের চেহারার অবস্থা বিকৃত করতাম শুধু। ছকে আঁকা জীবন, বেলা পড়ে যেতে শুরু করলেই তাড়াহুড়ো করে মাঠ হতে গরু এনে গোয়াল ঘরে রেখে হাত পা ধূয়ে নিজেকে শৃক্সখলিত করার চূড়ান্ত— প্রস্তুতি। তাই তখন বড় রহস্যময় মনে হতো সবকিছু। বিয়ে, বউ, সন্তান এতো সব চিন্তা হয়তো সবসময় মাথায় থাকতো না। কিন্তু যেদিন ঐ বুড়ি বাড়ির উঠোনে বসে শুরু করতো, “হারামজাদী আমার পোলার মাথা খাইছে গো, আইজ এতোটা বছর না একটা সন্তান দিবার পারলো, না পোলারে বিয়ে করাইতে দিলো…”। তখনইতো মাথার গা ঝাড়া দিয়ে উঠতো সেই অমোঘ সহস্যটা। কারো কারো বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কূল জুড়ে আসে সন্তান। কারো তিন বছর পর, কারো পাঁচ বছর, কারো সারা জীবনেও না। প্রশ্ন করার সাহসতো হতোইনা পাশে শুনারও সাহস ছিলো না মাঝে মাঝে অতিরিক্ত কৌতূহলে মাকে যখন জিজ্ঞাসা করতাম “মা বাচ্চা হয় না কেন?” তখন মার রক্তচক্ষু আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যেতো অনেক দূর। আর এখনতো নিজেই এক জলজ্যান্ত রহস্য হয়ে বসে আছি। মুখটাকে নগ্ন করে চেহারার রং ফুটাতে মুখে কাঁচি চালাতে হয় নিয়মিত। বিয়ে, বউ, সন্তান এক বছর। তিন বছর, পাঁচ বছর এসবতো মামুলি ব্যাপার। তাই আজ এতোদিন করে গাঁয়ের সেই বুড়ির আবদার, অভিযোগ আর অশান্তির যথার্থতা বসেছি। প্রায় প্রতিদিনই দেখা যেত লাঠিতে ভর দিয়ে বুড়ি গ্রামের কোন না কোন বাড়িতে এসে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো হারামজাদী দিয়ে শুরু তারপর বিকৃত হতো গালি সময়ের সমানুপাতে।

….গ্রামের একপাশেই প্রায় সব বাড়ি। গা ঘেষাঘেষি করে দাড়ানো বাড়িগুলো পৃথক করার কারও কোন চিন্তা ছিলো বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে বাঁশঝাড় নিয়ে অথবা নালা নিয়ে একটু আধটু কথাবার্তা ব্যাস। গ্রামের সামনে রাস্তা তার পরেই অবারিত মাঠ…। কখনও সবুজ, কখনও ধূসর, কখনও সোনালী। মাঠের সৌন্দর্যের শেষ নেই। ঋতুর সাথে তাল মিলিয়ে মাঠ যেন বদল করে তার রূপ, সৌন্দর্য, অলংকার আর সেই মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ক্যানেল। শুকনো মৌসুমে কৃষকের একমাত্র ভরসা।… সেই ক্যানেলের পাড়ে জন বিচ্ছিন্ন এক বসতি। বাশের ছাউনী দিয়ে ঘেরা সেই ঘর। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন এটা বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ। ঘন অপরিকল্পিত ভাবে লাগানো ছোট বড় অনেক গাছ দিয়ে যেন আড়াল করে রাখা হয়ে সেই জীবন যাপন। এই বাড়িরই বাসিন্দা বুড়ি। গ্রামের সাথে সম্পর্ক বলতে ঐ বুড়ির মাঝে মধ্যে গ্রামে আসা। আর তার গ্রামে আসা মানে তার একমাত্র পুত্রের জন্য হাহাকার এবং পুত্রবধূর জন্য একরাশ ঘৃণা, অভিযোগ আর অভিশাপ। বুড়ি এসেই মাটিতে বসে পড়তো, আর অতি প্রাকৃত নিয়মে শুরু করতো তার ভাষণ। “আমার পোলার মাথা খাইছে গো মা, পোলারে বিয়া করনের কথা কইলেই পোলা খেইপ্যা যায়, কত তাবিজ-পুরাণ করলাম তবুও হারামজাদীরে পোয়াতী বানাইতে পারলাম না” তখন হয়তো এ কথাগুলো দুর্বোধ্য আর খুব কঠিন মনে হতো কিন্তু এখন বড়ো মায়া এদের জন্য। কি গভীর অন্ধকার আর কুসংস্কারের মাঝে কাটে এদের জীবন। তখনও গ্রামে সবুজ ছাতা সবুজ সাথীদের সবুজ সংকেত পৌঁছায়নি। সমস্যা না বুঝেই সমাধানের পিছু ছুটতো সবাই দল বেধে…অকারণে পরিবার পরিকল্পনা কখনও এদের কল্পনাকে জয় করতে পারে কিনা জানি না।

বুড়ির কথা শুনে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম। মনে মনে ভাবতাম মাথা খাওয়া মানে কি। বাড়ি থেকে একটু বাহির হলেই ঐ বিচ্ছিন্ন দ্বীপটার দিকে আমার চোখ আটকে যেত… কেন জানি। একবার গরু আনার নাম করে মাঠ পেরিয়ে চলে যাই সেই বাড়িতে। ঘন গাছগাছালিতে ভরা বাড়ির পাশাপাশি। যেতেই বুড়ির চিৎকার শুনতে পাই, “তোরে বিয়া করন লাগবো, আমার বংশের বাত্তি জ্বালাইবার মানুষ আমি চাই, ঐ হারামজাদীরে দিয়ে আর হইবো না”। এবার বুড়ির ছেলে আবুল ক্ষেপে যায়।” ঐ বুড়ি ঐ চুপ থাক। বংশের বাত্তি… কতো বড়ো বড়ো রাজা মহারাজাগোর বংশ নিঃবংশ হইলো। হে আইছে আমার বংশের বাত্তি জ্বালাইতে।” বাক বিতন্ডার তুমুল মুহূর্তে এক সময় বুড়ি তার পুত্র বধূর উপর ক্ষেপে। কিন্তু জমিলা নামের সেই মেয়েটি নিশ্চুপ নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিন খুব খারাপ লেগেছিলো তার জন্য। বুড়ি তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে গ্রামের দিকে পা বাড়ায়। আর জমিলা পরম অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আবুল যখন তার পাশে এসে দাড়ায় তখন অশ্রুসিক্ত চোখে সে আবুলের দিকে তাকায়, সব অত্যাচার, অপবাদ সে মুখ বুঝে সহ্য করে যেন নিজের বন্ধ্যাত্বকেই মনে নেয় নিয়তি হিসেবে। আর আবুও আকাশের দিকে চোখ তুলে ভাবে এতে সুন্দর উদ্দামী জমিতে সে এতো চেষ্টা করেও কেন ফসল ফলাতে পারে না। আবুল জমিলাকে বুকে টেনে নেয় গভীর মমতায়… আর জমিলা আবুলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।

ভাঙা ভাঙা কন্ঠে আবুলকে আবার বিয়ের কথা বললে আবুল শান্ত, নীরব, নিরোত্তাপে চেয়ে থাকে শূন্যে, তখন সূর্য তার সব অহংকার হারিয়ে হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। আমি গরু নিয়ে বাড়ির পথ ধরি আর স্বপ্ন হারানো ছন্দহীন একজোড়া মানুষ নিয়তির কাছে হেরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মুখোমুখি… তাদের নীরব দৃষ্টি, মৌনতা ছুয়ে যায় পৃথিবীর সব কষ্ট, হতাশা…অবশ্য তখন আরো একটা ভাবনা আমাকে ভাবিয়ে তুলতো যে, আবুলের দ্বিতীয় বিয়েতে আপত্তি কেন? এখন বুঝি কেন জমিলার মতো আবুলও নিজের নিয়তিকে বরণ করে নিয়েছিল! অবহেলা আর অনাদরে বেড়ে ওঠা জমিলার রং কালো ছিলো ঠিকই কিন্তু এখন বুঝি আবুলের নেশাগ্রস্থ চোখদুটো সবসময় খুঁজে ফিরতো জমিলার শরীরের প্রতিটি বাকের সেই বুনোযৌবন। সৃষ্টিকর্তা জমিলার শরীর তৈরিতে মনে হয় কোন কার্পণ্য করেননি তাই হয়তো জমিলার ঐ বুনো কামনা মাতাল করে রাখতো আবুলকে, আবুলের সব চেতনাকে। আর আবুলও হয়তো চাইতো না জমিলার প্রতি তার আবেগ, আদর, প্রেম-ভালোবাসায় অন্য কেউ ভাগ বসাক। তাই নিঃসন্তান হয়েও সে জমিলাকে জড়িয়ে রেখেছিলো তার লোমশ বুকের ভাঁজে ….. আর বুড়ি এখানেই পেয়েছিলো জমিলা কর্তৃক তার ছেলের মাথা খাওয়ার সুত্র। ঐ ডাইনী হারামজাদীর কবল থেকে পুত্রকে ফেরাতে সে অনেক কিছু করেছে কিন্তু লাভ হয়নি। এখন মাঝে মাঝে ভাবি জমিলার সংসার গোছানো, স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় আবুলের কামনা বাসনা পূর্ণ করার মুহূর্তে তার বন্ধ্যাত্ব কি তাকে পীড়া দিত, নিরুৎসাহিত করতো। তার প্রতি আবুলের এই টানকি ভুলিয়ে দিতে পারতো তার হতাশা। আর আবুল যখন দিনের কর্মক্লান্তি গাঢ় নিঃশ্বাসে ঝেড়ে ফেলে দিতো জমিলার বুকে তখন কি আবুলও সন্তানহীনতায় হয়ে যেত অবসাদগ্রস্থ, নিরুৎসাহিত। একটি সন্তানের জন্য তাদের হাহাকার কি হানা দিতো তাদের একান্ত মুহূর্তে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনা। নিজের অজান্তে হলেও কি সন্তানের আকাংখা তার কামনাকে অতিক্রম করতো না? হয়তো করতো। লোকমুখে শুনেছি আবুলের অনুপস্থিতিতে নাকি বুড়ি জমিলাকে খুব মারধর বকাবকি করতো কিন্তু জমিলা কোনদিন কোন প্রতিবাদ করতো না মুখ বুঝে তার শ্বাশুড়ির সব যন্ত্রণা সহ্য করে যেন, নিজের বন্ধ্যাত্বের ফলে সে বরণ করে নিত অথবা তার প্রতি আবুলের ভালোবাসা তাকে এসব মেনে নিতে বাধ্য করেছিলো।

আবুল, জমিলা আর বুড়ির রহস্য বুঝে উঠার আগেই আমাকে গ্রাম ত্যাগ করতে হয়। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। পরে অবশ্য পাখা গজাতে শুরু করলে ভুলতে বসি, সেই মাঠ, পুকুর ঘাট, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, বুড়ি, আবুল জমিলা… ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে জমা হতে থাকে নতুন নতুন চিন্তা, ধ্যান ধারণা এ সবের মাঝে বুড়ি, আবুল এরা জায়গা করে নিতে পারতো না তাই তাদের নিয়ে ভাবা হয়ে ওঠতো না। বাড়িতে আসলে খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতাম। নিজের মধ্যে তৈরি করতে থাকি অন্য এক জগৎ, স্বপ্ন , ইচ্ছা, লক্ষ্য … ভুলে যেতে থাকি তাল পাকা দুপুরে পুকুরে ঝাপ, বিকেলে গরুর গোয়ালের ব্যস্ততা তাই আর এসব নিয়ে ভাবা হয়ে ওঠে নি। জমিলার বুনোযৌবনে আবুলের ভালোবাসা নিজের স্মৃতির বাইরে চলে যায়।

…কিন্তু একবার বাড়িতে এসে আমার মনে পড়ে সেই বুড়ির কথা। রাস্তায় এসে চোখ রাখি সেই দ্বীপের দিকে। অবশ্য এখন আর দ্বীপ বলা যায় না। গ্রাম থেকে এখন অনেকেই ঐ দিকে ঘর করছে দু’একটি ঘরের নতুন চাল দুপুরের রোদে চিকচিক করে নিজের অবস্থান জানান দেয় বেশ অহংকারের সাথে। কিন্তু আমার চোখ গেঁথে থাকে আবুলে সেই গাছে ঘেরা বাড়ির প্রতি। তখনই চোখের সামনে ভাসতে থাকে বুড়ির প্রলাপ জমিলার অসহায়ত্ব, বুনো যৌবনা শরীর, আবুলের যন্ত্রণা। আবুলের কথা জানার জন্য মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। আবুল কি জমিলার মোহ ত্যাগ করে দ্বিতীয় বিয়ে করছে? সে কি দেখতে পেয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত সন্তানের মুখ? এরকম নানাবিধ প্রশ্ন আমাকে বিদ্ধ করতে থাকে। পা বাড়াই আবুলের বাড়ির দিকে কিন্তু কিছুদূর গিয়ে পরিচিত একজনের সাথে দেখা হলে জানতে চাই আবুলের সংসারের খবর। সে আমাকে বড়ো নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় জবাব দেয়, “আবুলের মাতো নেই” আমি থমকে যাই। আমি ভাবতে চেষ্টা করি বুড়ির শেষ সময়ের আর্তনাদ, তার মৃত মুখ। লোকটির কথায় আমার চেতনা ফিরে আসে, সে আবার বলে, “মরার আগে বুড়ি একটা ছাওয়ালের লাগি খুব কান্নাকাটি করছে।” ছ্যাৎ করে ওঠে বুকটা তার মানে আবুলকে সে নিঃসন্তান রেখেই মারা গেছে। আমার মন এবার চঞ্চল হয়ে ওঠে আবুলের জন্য, জমিলার জন্য। তাকে আবুলের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে বলে, “আবুলের তো ওহন দুই বউয়ের সংসার।” এবার আর স্থির থাকতে পারলাম না। অবাক বিস্ময়ে আমার বোবা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। নিজের অজান্তেই অস্পষ্ট ভাবে বলি, “আবুল আবার বিয়ে করেছে।” লোকটি মাথা নাড়ে। আমি চুড়ান্তভাবে অবাক হই। বাস্তবতার কাছে তাহলে ভালোবাসা হার মানলো। একটি সন্তানের জন্য স্বামীর আদর ভালোবাসায় ভাগ বসানো আরেকটা নারীকে জমিলা গ্রহণ করে নিল আর আবুল জমিলার প্রতি তার আবেগ, আদর ভালোবাসা ছাড়িয়ে বড় করলো সন্তানের জন্য হাহাকার। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার তেমন কোন কারণ মনে হয় নেই …. জমিলা, আবুল না বুড়ি কার জন্য জানি না করে জন্য বুকের পাজরে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম যখন লোকটার মুখে শেষ কথাটা শুনলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা বললো যে, আবুল আবার বিয়ে করছে, তার দ্বিতীয় বিয়ের বয়স প্রায় চার বছর হতে চললো এখনও সে নিঃসন্তান….।

লেখকঃ হোসেন মৌলুদ তেজো
বইঃ অপ্রকাশিত।

About Md. Moulude Hossain

FinTech | Digital Payment | Product Strategy | Product Management | EMV | Business Development

Discussion

One thought on “বুড়ীর প্রলাপ এবং আবুলের দ্বিতীয় বিয়ে

  1. অনেক কথা বলা হয়ে গেছে না বলার মতো করে, অনেক গল্পের পটভূমি আকা হলো একটি অসম্পূর্ণ গল্পের মোড়কে।

    Posted by সুমন সুপান্থ মজুমদার | June 15, 2020, 8:31 pm

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

upay-GP Offers

Blog Stats

  • 103,113 hits

Archives

upay bonus

Recent Post

%d bloggers like this: